top of page
Search
  • Writer's pictureUltra ARB

ক্রুসেড সিরিজ:-1 আসাদ বিন হাফিজ

গাজী সালাহউদ্দীনের দুঃসাহসিক অভিযান

2


গভীর চোখে জুকির দিকে খানিক তাকিয়ে রইল নাজি। বলল, ‘তোমার এ মাতাল করা রূপযৌবনও হয়ত তাকে প্রভাবিত করতে পারবে না। তখন চালাবে ভাষার যাদু। এতদিনের ট্রেনিং ভুলে যেয়ো না। দেখো আবার তা বাঁদী না হয়ে যাও। মনে রেখ, তুমি হবে অচিন নগরের সেই ফোটা ফুল, যা ধরতে গেলে ধরা যায় না, আবার সেখান থেকে চোখও ফেরানো যায না। জুকি, তুমি সেই আলো, যার হাত থেকে কোন পতঙ্গের নিস্তার নেই। তুমি সেই মায়াবিনী, রক্ত মাংসের কোন মানুষের সাধ্য নেই তার আকর্ষণকে উপেক্ষা করে। মনে রেখ, সালাহউদ্দীনও মানুষ। ওকে তুমি তোমার পায়ের কাছে বসতে বাধ্য করবে। ক্লিওপেট্রা তার রূপ যৌবন দিয়ে লৌহমানবকে গলিয়ে মরুর বালির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিল। সে তোমার চে’ বেশী সুন্দরী ছিল না। আমি তোমায় যা শিখিয়েছি তা ক্লিওপেট্রারই পদ্ধতি। নারীর এ চাল কখনো ব্যর্থ হয় না।’


মৃদু মৃদু হাসছিল জুকি। মনোযোগ দিয়ে শুনছিল নাজির কথা। মিসরের বালুকারাশি থখেকে জন্ম নিয়েছিল ক্লিওপেট্রার মত রূপসী নাগিণী। ইতিহাস আরো একবার সে অতীতে ফিরে যাচ্ছিল।


সূর্য ডোবার সাথে সাথে জ্বলে উঠল হাজার হাজার মশাল। দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত হয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। দফ বাজিয়ে তাকে অভ্যর্থনা করা হল। ‘মিসরের আমীর সালাহউদ্দীন জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে মরুর নিস্তরঙ্গ প্রকৃতি মুখরিত হয়ে উঠল। নাজি এগিয়ে এসে বলল, ‘আত্মত্যাগী ও ইসলামের রক্ষক সেনাবাহিনী আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে। খোশ আমদেদ মহান নেতা, ওদের শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন। এই সে সেনাবাহিনী, আপনার ইশারায় যারা জীবন নবিলিয়ে দিতে প্রস্তুত।’ তোষামুদে শব্দগুলো নাজির কণ্ঠে প্রণচঞ্চল হয়ে উঠল। মসনদে বসলেন সালাহউদ্দীন ভেসে এল অশ্বক্ষুরধ্বনি। আলোর নিশানায় চলে এল ঘোড়াগুলো। দু’দিক থেকে আসছে চারটি করে ঘোড়া। আরোহীরা নিরস্ত্র। ছুটে আসছে মুখোমুখি। যে কোন মুহূর্তে সংঘর্ষ হতে পারে। আরোক াছে এগিয়ে আসতেই সওয়াররা স্যাডলৈ পা রেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। এক হাতে তুলে নিল বলগ। অন্য হাত আড়াআড়ািভাবে প্রসারিত করে একে অন্যকে পেরিয়ে গেল। যাবার সময় অপর আরোহীকে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করল ওরা। একজন প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য সওয়ারকে জাপটে ধরে ছুে গেল সামনে। দু’দল হারিয়ে গেল দিগন্তের বিস্তৃত মরুতে। সংঘর্ষের স্থানে মাটিতে ডিগবাজি খাচ্ছিল দু’জন সওয়ার।


এভাবে পরপর আটটি দল তাদের নৈপূণ্য দেখাল। এরপর এল উষ্ট্রারোহী বাহিনী। তাদের খেলা শেষ হতেই শুরু হল নেজাবাজি ও অসি চালনা। ওদের সাহস ও নৈপূণ্যে অভিভূত হলেন সালাউদ্দীন। এমন দুঃসাহসী সৈন্যই তো তার প্রয়োজন। তিনি আলী বিন সুফিয়ানের কানে কানে বললেন, ‘ইসালামি জোশ সৃষ্টি করতে পারলে এ ফৌজ দিয়েই সমস্ত খৃষ্টান শক্তিকে পরাভূত করা যায়।


আলী পূর্বের পরামর্শ পুনরাবৃত্তি করে বলল, ‘নাজিকে সরিয়ে দিন, দেখবেন এদের মধ্যে এমনিতেই ইসলামী জযবা ও আবেগ সৃষ্টি হয়ে যাবে।’


কিন্তু সালাইউদ্দীন আইয়ুবী একজন অভিজ্ঞ জেনারেলকে না সরিয়ে তাকে সংশোধন করতে চাইছিলেন। তিনি সেবানবাহিনীর অবস্থা দেখার জন্য যোগ দিয়েছিলেন সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে। নাজি যখন নাচগান এবং মদপানের প্রস্তাব করেছিল, নিরাশ হয়ৈ গিয়েছিলেন তিনি। এরা ভোগবিলাসে কদ্দুর ডুবে আছে তা দেখতে নাচগানের অনুমতি দিয়েছিলেন।


সাহসিকতা, ঘোড়া সওয়ারী, অসি চালনা এবং মল্ল যুদ্ধে সেনা সদস্যরা উতরে গিয়েছিল। কিন্তু খাবার সময় ওরা উচ্ছৃংখল হয়ে পড়ল। বিশাল এলাকা জুড়ে খাবারের আয়োজন করা হয়েছিল। একপাশে সেনা সদস্যদের জন্য, অন্যপাশ বিশেষ অতিথিদের। হরেক রকম খাবারের মনমাতানো গন্ধে মরুভূমির রাতের বাতাস ম-ম করছিল। সেপাইদের সামনে ছিল মদের মশক। খাওয়া শেষ হতেই ওরা মদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলেন সালাহউদ্দীন। কি ভাবছেন চেহারা দেখে বুঝা যাচ্ছিল না।


নাজিকে প্রশ্ন করলেন, ‘এদের কিভাবে নির্বাচিত করলেন? এরা কি ফৌজের নিকৃষ্টতম সিপাই?’


‘না, আমীর।’ মিনমিনে কণ্ঠে বলল নাজি, ‘এরা সেনাবাহিনীর শ্রেষ্ঠ সৈনিক। যুদ্ধের ময়দানে এদের বীরত্ব দেখলে আপনি হতবাক হয়ে যাবেন। ওরা একটু বাড়াবাড়ি হয়ত করছে, কিন্তু আপনার ইশারায় জীবন দিতে প্রস্তুত। আনন্দে উল্লাস করার জন্য মাঝে মাঝে ওদেরকে মুক্তভাবে ছেড়ে দেই। মৃত্যুর পূর্বে পৃথিবীটাকে খানিক ভোগ করে নিক।’


আইয়ুবী এ যুক্তির কোন জবাব দিলেন না। নাজি অন্য অতিথিদের দিকে ফিরতেই তিনি আলী বিন সুফিয়ানকে বললেন, ‘ যা দেখার আমি দেখেছি, এরা মদ আর উচ্ছৃংখলতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। তুমি বলেছিলে এদের ভেতর কোন আবেগ নেই, আমি দেখছি কোন কর্মও নেই। এরা যুদ্ধের ময়দান থেকে জীবন নিয়ে পালাবে। লুট করবে পতিত সম্পদ। বিজিত এলাকার মেয়েদর সাথে পশুর মত ব্যবহার করবে।’


‘এর ওষুধ হল, আলী বললেন, ‘আপনি বিভিন্ন এলাকার লোক দিয়ে যে ফৌজ তৈরী করেছেন, এদেরকে ওদের সাথে একীভূত করে দিন। ভাল সিপাইদের সাথে মিশলে এদের স্বভাব ভালও হয়ে যেতে পারে।’


মৃদু হেসে সালাহউদ্দীন বললেন, ‘নিশ্চয়ই তুমি আমার মনের কথা জানতে পেরেছ। একক্ষণ আমিও তাই চিন্তা ভাবছিলাম। আর কারো কাছে একথা প্রকাশ করো না।’


আলী কিছু বলতে যাচ্ছিল, সামনে কয়েকটি মশাল জ্বলে উঠল, বেজে উঠল সানাই আর সারিন্দার সুমধুর সুর। সমাবেশে নেমে এল অখণ্ড নীরবতা। একদিকে দেখা দিল নর্তকীর দল। পরনে ঝলমলে নাচের পোশাক। আধখোলা দেহ, নগ্ন কাঁধে ছড়ানো চুল।


হু হু করে বয়ে যাচ্ছে মরুভূমির উচ্ছল রাতের বাতাস। সে বাতাসে ওদের চুল উড়ছে, পতাকার মত পতপত ঢেউ খেলছে জরীন পোশাক। মনে হচ্ছে বাতাসে ভর করে উড়ে আসছে এক ঝাঁক সোনালী পায়রা। প্রসারিত দুই বাহু মেলে দেয়া দুই উড়ন্ত ডানা। সেই ডানায় বাঁধা রেশমী রুমাল। সেই রুমালে আঁকা বিচিত্র বর্ণালী রঙ। সেই রঙের ভেতর একেকটি মুখ ফুটে আছে রক্ত পদ্মের মত। কোমল, পেলব। মসৃন উন্মুক্ত বাহুলতায় অপার্থিব জ্যোতির পরাগ। পা নড়ছে না ওদের, কিন্তু বাদ্যের তালে তালে ছন্দোবদ্ধভাবে সামনে এগিয়ে আসছে।


দ্বিতীয়ার চাঁদের মত সালাহউদ্দীনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল যুবতীরা। মাথা নোয়াল কুর্ণিশ করার জন্য। সোনালী চুল পিছলে সামনে চলে এল।


দেখা গেল দূরে দৈত্যের মত এক হাবশী দ্রুতপায়ে এগিয়ে আসছে। পরনে চিতাবাঘের চামড়ার তৈরী পোশাক। হাতে বিশাল একা ডালা, ডালা ভর্তি অর্ধফোটা ফুল।


তরুণীদের সামনে এসে ওটা নামিয়ে রাখল সে। বেড়ে গেল বাদ্যের আওয়াজ। বন্য মোষের মত গজরাতে গজরাতে আবার ফিরে গেল কাফ্রী।


নড়ে উঠল দ্বিতীয়ার চাঁদ। চাঁদের খোলস ভেঙ্গে বেরিয়ে এল অনিন্দ্য এক চাঁদবদনী। মনে হল ধূসর মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে পূর্ণিমার চাঁদ। যেন এ যুবতী এ গ্রহের কেউ নয়। ঠোঁটে তার মৃদু হাসির ঝিলিক। হাসি তো নয়, যেনো অনবদ্য এক খাপখোলা তলোয়ার।


অবাক বিস্ময়ে মোহগ্রস্থের মত তাকিয়ে রইল দর্শকবৃন্দ। দৃষ্টি তাদের পলকহীন। স্মিত হেসে সালাহউদ্দীনের দিকে তাকালেন আলী বিন সুফিয়ান, আইয়ুবীর ঠোঁটেও মুচকি হাসি।


‘ও এতটা সুন্দরী, ধারণা করিনি।’ আলীর কানে কানে বললেন তিনি।


‘মিসরের আমীরের জয় হোক,’ বলতে বলতে এগিয়ে এল নাজি। ‘ওর নাম জোকি।’ বলল সে, ‘আপনার জন্য ইস্কান্দারিয়া থেকে আনিয়েছি। ও নর্তকী বা দেহপশারিণী নয়। কখনো সখনো শখের বশে নাচে বটে, তবে কোন জলসায় যায়না। ওর পিতা আমার পরিচিত, বড় ব্যবসায়ী। এ মেয়েটা আপনার খুব ভক্ত। আপনাকে ও প্রাণ দিয়ে ভালবাসে না বলে বরং নবীর মত সম্মান করে বলাই ভাল। ঘটনাচক্রে হঠাৎ ওর বাবার সাথে দেখা। একটা কাজে ওদিকে গিয়েছিলাম। মেয়েটা বলল, ‘শুনেছি সালাহউদ্দীন আইয়ুবী মিসরের গভর্নর হয়ে এসেছেন? মেহেরবানী করে আমাকে তার সাথে দেখা করিয়ে দেবেন? তাকে দেয়ার মত আমরা জীবনে আর নাচ ছাড়া কিছুই নেই। মাননীয় গভর্নর, এ মেয়েটাকে আপনার সামনে হাজির করার জন্যই নাচগানের অনুমতি চেয়েছিলাম।’


‘আপনি কি ওকে বলেননি, মেয়েদের অর্ধনগ্ন দেহ বা নাচগান আমি পছন্দ করি না। আপনি যাদের পোশাক পরা বলছেন ওরাতো সবাই উলংগ।’


‘মহামান্য আমীর’, ফ্যসফ্যসে গলায় বলল নাজি, ‘আপনি নাচ গান পছন্দ করে না একথা আমি ওকে বলেছি। ও বলল, আমার নাচ তিনি পছন্দ করবেন। কারণ, আমার নৃত্যে পাপের আহ্বান নেই। দেহ নয়, আমীরকে আমি শালীনভাবে নৃত্যের শৈল্পিক কলাকৌশল দেখাব। আমি পুরুষ হলে তার নিরাপত্তার জন্য জীবন বিলিয়ে দিতাম।’


‘আপনি কি বলতে চাইছেন?’


‘ওকে কাছে ডেকে একটু ধন্যবাদ জানালে ও খুব খুশী হবে।’


‘আপনি চাইছেন আমি তাকে ডেকে বলি যে, হাজার হাজার মানুষের সামনে তোমার নগ্ন দেহটাকে সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছ, পুরুষের ঘুমন্ত পশু সত্ত্বাকে উসকে দিতে তোমার জুড়ি নেই, এ জন্য তোমাকে ধন্যবাদ!’


‘ছি! ছি! তা কেন করবেন মাননীয় আমীর। আমি ওকে কথা দিয়েছিলাম, এখানে এলে ওকে আপনার সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করে দেব। মেয়েটা অনেক আশা নিয়ে এসেছে। দেখুন ওর নৃত্যে পাপের আহবান নেই, আছে নীরব আত্মসমর্পণ। দেখুন না কেমন করে ও আপনার দিকে তাকিয়ে আছে! ও তার নৃত্যের কলাকৌশল, ভালবাসা, শ্রদ্ধা এবং মাদকতাময় দৃষ্টি দিয়ে আপনার উপাসনা করছে। কয়েক মুহূ্র্তের জন্য ওকে আপনার তাঁবুতে আসার অনুমতি দিন। আগামী দিন যারা হবে ইসলামের রক্ষক, ও হবে সে বীরপ্রসু মায়েদের একজন। নিজের সন্তানদের কাছে গর্ব করে বলতে পারবে যে, আমি সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর সাথে একান্তে কথা বলেছি।’


‘ঠিক আছে ওকে আমার তাঁবুতে পাঠিয়ে দেবেন।’


অপূর্ব দেহবল্লরীতে কম্পন তুলে নাচছে জুকি। মদির কটাক্ষ হেনে তাকাচ্ছে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর দিকে। ঠোঁটে মধুমাখা মিষ্টি হাসির ঝিলিক। অন্য মেয়েরা প্রজাপতির মত তিরতির করে উড়ে বেড়াচ্ছে। মশালের ক্ষীণ আলোয় মনে হচ্ছে বরফগলা ঝরনার স্বচ্ছ পানিতে ফুলপরীরা দল বেঁধে সাঁতার কাটছে।


নিশ্চুপ বসে ছিলেন আইয়ুবী। নাজির সৈন্যরা মদে মাতাল। মরুভূমির সেই খোলা প্রান্তরে নিশুতি রাতের প্রকৃতিতে ভেসে বেড়াচ্ছে এক অপার্থিব সুর শিহরণ। ছন্দের তালে তালে বেজে চলছে নুপুরের নিক্কন ধ্বনি।


নিজের সাফল্যে নাজি ভীষণ খুশী। নাচ চলছে, ধীরে ধীরে গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে রাত।


মাঝরাতে তাঁবুতে প্রবেশ করলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। মেঝেতে দামী কার্পেট। দরজায় ঝুলানো রেশমী পর্দা। পালংকে চিতাবাঘের চামড়ার তৈরী আচ্ছাদন। কক্ষে মরু জ্যোস্নার মত ঝাড় বাতির হালকা নীলাভ আলোর ফুলঝুরি, বাতাসে মোহনীয় আতরের সুবাস।


নাজি তাবুতে ঢুকে বলল, ‘ওকে কিছু সময়ের জন্য পাঠিয়ে দেব মহামান্য আমীর? আমি প্রতিশ্রুতি ভাঙতে ভয় পাই।’


‘হ্যাঁ, পাঠিয়ে দাও।’


ধূর্ত শিয়ালের মত লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে গেল নাজি। খানিক পর দেহরক্ষীরা দেখল এক নর্তকী সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর তাবুর দিকে এগিয়ে আসছে। কাছে আসতেই তরুণীকে চিনতে পারল ওরা, এখনো নাচের ফিনফিনে পোশাক পড়ে আছে। রক্ষীরা ওর পথ আটকে দাঁড়াল। ও বলল, ‘মহামান্য গভর্ণর আমায় ডেকে পাঠিয়েছেন।’


কমাণ্ডার বলল, ‘যেসব আমীর বাজে মেয়েদের সাথে রাত কাটায় সালাহউদ্দীন আইয়ুবী তাদের মত নয়।’


‘তাকেই জিজ্ঞেস করে দেখ না, না ডাকলে কোন সাহসে আমি এখানে আসব?’


‘কার মাধ্যমে তোমায় ডেকে পাঠিয়েছেন?’


‘সেনাপতি নাজি আমাকে বললেন, গভর্ণর তোমায় ডাকছেন। আপনারা বললে আমি ফিরে যাচ্ছি, কিন্তু এর সব দায় দায়িত্ব আপনাদের।’


সালাহউদ্দীন আইয়ুবী এক নর্তকীকে শোবার ঘরে ডাকবেন, রক্ষীদের কাছে তা অবিশ্বাস্য মনে হল। তারা জানত, তিনি কেমন প্রকৃতির মানুষ। তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, নাচগানের সাথে যারা সম্পর্ক রাখবে তাদের একশত বেত্রাঘাত করা হবে। সমস্যায় পড়ল রক্ষী কমাণ্ডার। তবু ভয়ে ভয়ে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর তাবুতে প্রবেশ করে কম্পিত কণ্ঠে বলল, ‘বাইরে এক নর্তকী দাঁড়িয়ে আছে, আপনি নাকি তাকে ডেকেছেন।’


‘হ্যাঁ, ওকে ভেতরে পাঠিয়ে দাও।’


কমাণ্ডার বেরিয়ে গেল। তাঁবুতে প্রবেশ করল জুকি। রক্ষীদের ধারণা ছিল, গভর্ণর তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাঁবু থেকে বের করে দেবেন। আইয়ুবীর বজ্র হুংকার শোনার জন্য ওরা কান পেতে রইল। কিন্তু এমন কিছুই ঘটল না।


রাত এগিয়ে যাচ্ছে। তাঁবুর ভেতর শোনা যাচ্ছে অনুচ্ছ কণ্ঠের আওয়াজ। কমাণ্ডার সীমাহীন উদ্বেগ নিয়ে বাইরে পায়চারী করতে লাগল। এক রক্ষী বলল, ‘বাজে মেয়েদের সাথে সম্পর্ক রাখা নিষেধ শুধু আমাদের জন্য।’


‘হ্যাঁ, অন্যজন বলল, ‘অধীনস্ত আর প্রজাদের জন্যই শুধু আইনের কড়াকড়ি। গভর্ণরকে তো আর বেত মারা যাবে না!’


‘রাজা বাদশাদের কাজই এমন।’ কমাণ্ডাররের কণ্ঠে ঝাঝ। ‘হয়ত তিনি মদও পান করেন, উপরের গাম্ভীর্য কেবল আমাদের প্রভাবিত করার জন্য।’


একটি মাত্র ঘটনায় সালাহউদ্দীন আইয়ুবী সম্পর্কে ওদের এতদিনকার সকল ধারণা নিঃশেষ হয়ে গেল। ওদের চোখের সামনে ভেসে উঠল এক বিলাসপ্রিয় চরিত্রহীন রাজকুমারের ছবি।


নাজির খুশীর অন্ত নেই। সালাহউদ্দীন টোপ গিলেছে। তাকে সন্তুষ্ট করার অস্থিরতায় আজ সে মদ পর্যন্ত স্পর্শ করেনি। হৃদয়ভরা আনন্দ নিয়ে এডরোসসহ তাবুতে ঝিমুচ্ছিল সে।


এডরোস বলল, ‘ও অনেক্ষণ হয় গেছে। সম্ভবত আমাদের নিক্ষিপ্ত তীর সালাহউদ্দীনের হৃৎপিণ্ডে বিঁধে গেছে।’


‘আমার নিক্ষিপ্ত তীর কখনো লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না।’ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল নাজি।


‘তীরের নিশানা ভুল হলে এতোক্ষণে ও ফিরে আসত। তুমি ঠিকই বলছ, জুকী মানুষরূপী এক যাদুকন্যা। নয়তো সালাহউদ্দীনের মত পাথর গলাতে পারত না।’


‘আমি যে ট্রেনিং তাকে দিয়েছি, ঘাতকদল তা কল্পনাও করতে পারবে না। সালাহউদ্দীনকে এখন শুধু মদ খাওয়ানোটা বাকী।’


বাইরে কারো পদশব্দে নাজি তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। তাবুর পর্দা তুলে তাকাল বাইরে। না, জুকি নয়, একজন সৈনিক যাচ্ছে। নাজি দৃষ্টি ছু্ঁড়ল আইয়ুবীর তাবুর দিকে। বাইরে রক্ষীরা টহল দিচ্ছে। ফিরে এসে এডরোসকে বলল, ‘এবার আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি আমার জুকি পাথর ভেঙেছে।’


রাতের শেষ প্রহর। সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর তাবু থেকে বেরিয়ে এল জুকি। নাজির তাবুর দিকে না গিয়ে হাঁটা দিল অন্য দিকে। পথে আপাদমস্তক ঢাকা একজন লোক দাঁড়িয়ে। লোকটি জুকিকে ইশারায় কাছে ডাকল, এগিয়ে গেল জুকি। লোকটি তাকে অন্য এক তাবুতে নিয়ে গেল। অনেকক্ষণ পর নাজির তাবুর দিকে হাঁটা দিল ও।


নাজির চোখে ঘুম নেই, ও একবার তাঁবুর ভেতরে ঢুকছিল, আবার বেরিয়ে আসছিল অস্থিরভাবে। কখনো হৃদয়ে তোলপাড় করা আনন্দ নিয়ে তাকাচ্ছিল আইয়ুবীর তাবুর দিকে। আকাশের উদার বিস্তার থেকে সালাহউদ্দীনকে তার পায়ের কাছে নামিয়ে এনেছে জুকি।


‘এডরোস, রাত তো শেষ হয়ে এলো, এখনো যে ও ফিরল না!’


‘ও আর কখনো ফিরে আসবে না। গভর্ণর তাকে সাথে নিয়ে যাবে। কোন রাজপুত্রও এমন হিরের টুকরো ফেলে দিতে পারে না, এদিকটা ভেবেছ কখনো?’


‘না তো! এদিকটা চিন্তাও করিনি।’


‘গভর্ণর তাকে বিয়েও তো করে নিতে পারেন! তাহলে মেয়েটা আমাদের কোন কাজেই আসবে না।’


‘ও যথেষ্ট সতর্ক।’


তবুও এক নর্তকীকে কদ্দুর বিশ্বাস করা যায়। নিজে অভিজ্ঞ পেশাদার নাচিয়ে। মা-ও বাঈজী ছিল। অবশ্যই সে আমাদের ধোঁকা দিতে পারে। ‘


গভীর চিন্তায় ডুবে গেল ওরা।


তাবুতে ঢুকলো জুকি। হেসে বলল, ‘এবার আমাকে আমার দেহের ওজন পরিমাণ স্বর্ণ দিন। ‘


‘কি হয়েছে আগে বলবে তো!’ নাজির কণ্ঠে অস্থিরতা।


‘আপনি যা চাইছিলেন তাই। আপনাকে কে বলল সালাহউদ্দীন পাথর, খোদার ভয়ে ভীত এক অনড় মুমীন।’ মাটিতে পা ঠুকে বলল জুকি, ‘সে মরুভূমির বালুর চাইতেও বেশী অসহায়, সামান্য বাতাসই তাকে উড়িয়ে নেয়ার জন্য যথেষ্ট।’


‘তোমার রূপের জৌলুস আর কণ্ঠের মধু তাকে উতলা করে দিয়েছে।’ এডরোস বলল, ‘নয়তো হারামিটা একটা দুর্গম পাথুরে পর্বত।’


‘পাথুরে পর্বত ছিল, এখন বালিয়াড়িও নয়।’


‘আমার ব্যাপারে কোন কথা হয়েছে?’ নাজির প্রশ্ন।


‘হ্যাঁ, জিজ্ঞেস করল নাজি লোকটা কেমন? আমি বলেছি, মিসরে আপনার বিশ্বস্ত এবং অনুগত কেউ থাকলে একমাত্র নাজিই রয়েছে।’


‘আমার সাথে পরিচয় কিভাবে জানতে চায়নি?’


‘চেয়েছে, বলেছি তিনি আমার পিতার অন্তরঙ্গ বন্ধু। আমাদের বাড়ী গিয়ে আব্বাকে বললেন, আমি সালাহউদ্দীনের নফর। তিনি যদি আমায় সাগরে ঝাঁপ দিতে বলেন, তাও আমি দিব।’


‘বাহাব, বেশ বলেছ।’


‘আমার কথা শুনে তিনি বললেন, তুমি তো ভদ্রঘরের এক সম্ভ্রমশীলা তরুণী। আমি তাকে বললাম, অন্যের কাছে আমি যাই হই, আপনার কাছে আমি নগন্য এক দাসীমাত্র। আপনার ইশারাই আমার জন্য নির্দেশ।’


‘তারপর?’


‘আমার এ কথায় প্রভাবিত হয়ে তিনি বললেন, তুমি খুব ভাল মেয়ে। আরে অত দূরে কেন, আরেকটু কাছে এসে বসো। আমি খুব লজ্জিতভাবে জড়তা ও দ্বিধার ভাব নিয়ে তার পাশে গিয়ে বসলাম। আগে তিনি পাথর থাকলেও আমার দেহের স্পর্শে বলা যায় মোমের মত গলে গেছেন। বিদায়ের সময় আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে বললেন, জীবনে এই প্রথম পাপ করেছি। আমি বললম, আপনি কোন পাপ করেননি, প্রতারণা বা জোরাজুরিও করেননি। অন্যান্য শাসকদের মত জোর করেও ধরে আনেননি। আমি স্বেচ্ছায় এসেছি, আপনার অনুমতি পেলে আবারও আসব, বারবার আসব।’


নিজের নগ্ন দেহের মত অনেক মিথ্যা অবলীলায় বলে গেল জুকি। আনন্দের আতিশয্যে জুকিকে জড়িয়ে ধরল নাজি। এডরোস দু’জনকে ধন্যবাদ জানিয়ে তাবু থেকে বেরিয়ে গেল।


রহস্য ঘেরা মরুরাতের জঠর থেকে জন্ম নিল একটি প্রভাত, তবে অন্য প্রভাতের চেয়ে ভিন্ন। এ ভোরের আলো মরুরাতের আঁধার বুকে এমন এক নিগূঢ় তথ্য লুকিয়ে রাখল, যার মূল্য সমগ্র মুসলিম বিশ্বের সমান। গতরাতে ঘটে যাওয়া রহস্যের দুটি দিক ছিল। একটি জানত নাজি এবং এডরোস। দ্বিতীয়টি আইয়ুবীর দেহরক্ষীরা। আর দু’টি দিকই জানতেন আলী বিন সুফিয়ান, আইয়ুবী এবং জুকি।


সালাহউদ্দীন এবং তার সঙ্গীদের অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে বিদায় দিয়েছিলেন নাজি। দুই সারিতে দাঁড়িয়ে ছিল সুদানী ফৌজ। ‘সালাহউদ্দীন আইয়ুবী জিন্দাবাদ’ এর ধনিতে প্রকম্পিত হল আকাশ বাতাস। কিন্তু আইয়ুবী মৃদু হাসি বা হাত নেড়ে এ অভিবাদনের কোন জবাব দিলেন না।


নাজির সাতে হাত মিলিয়ে দ্রুত ঘোড়ায় চেপে বসলেন তিনি। তাকে অনুসরণ করল অন্য সংগীরা। অফিসে গিয়ে আলী এবং একজন সহকারীকে নিয়ে কক্ষের দরজা বন্ধ কর দিলেন তিনি। দিন কাটলালেন রুদ্ধদ্বার কক্ষে।


সুর্য ডুবে গেল। রাতের অন্ধকার গ্রাস করল পৃথিবী। কিন্তু তিনি রুদ্ধদ্বার কক্ষের দরজা খুললেন না। কক্ষে খাবার বা পানি দেয়ারও সুযোগ দিলেন না কাউকে। অনেক রাতে তিনজন কক্ষ থেকে বেরিয়ে নিজ নিজ ঘরের দিকে হাঁটা দিলেন।


আলী বিন সুফিয়ান একা হতেই কমাণ্ডার তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।


‘জনাব’ অভিমান ভরা কমাণ্ডারের কণ্ঠ, ‘নির্দেশ পালন করা এবং মুখ বন্ধ রাখা আমাদের দায়িত্ব। কিন্তু আমার সিপাইদের মধ্যে অসন্তুষ্টি আর নৈরাশ্য ছড়িয়ে পড়েছে। আমরাও একই অবস্থা।’


‘কেন, কি হয়েছে?’


‘রক্ষীরা বলছে, সুদানী বাহিনীর জন্য মদ বৈধ হলে আমরা কি অপরাধ করেছি? আমার অনুযোগকে অপরাধ মনে করলে যে কোন শাস্তি মাথাপেতে গ্রহণ করব। গভর্ণকে আমরা একজন সৎ চরিত্রবান এবং খোদাভীরু লোক বলে জানি, হাসিমুখে জীবন বিলিয়ে দিতে পারি তার সামান্য ইশারায়।’


‘কিন্তু গত রাতে তার তাবুতে এক নর্তকী প্রবেশ করেছিল, এইতো!’ কমাণ্ডারের মুখের কথা টেনে নিলেন গোয়োন্দা প্রধান। ‘না, তুমি কোন অপরাধ করনি। রাজা করুক আর প্রজা করুক, পাপ সে পাপই। আমি তোমাকে আশ্বাস দিচ্ছি, গভর্ণরের সাথে গোপন সাক্ষাতের মধ্যে পাপের কোন সম্পর্ক ছিল না। তাদের মধ্যে কি কথা হয়েছে এ মুহূর্তে বলা যাবে না। কয়েকটা দিন যাক, সব নিজেরাই বুঝতে পারবে।’


কমাণ্ডারের কাঁধে হাত রেখে তিনি আবার বললেন, ‘আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোন আমের বিন সালেহ, তুমি অভিজ্ঞ সৈনিক। ভাল করেই জান ফৌজ এবং ফৌজি কর্মকর্তাদের এমন কিছু গোপন ব্যাপার থাকে যার গোপনীয়তা রক্ষা করা সকলের কর্তব্য। নর্তকী আইয়ুবীর তাবুতে গিয়েছিল তাও এক গোপন ব্যাপার। কাউকে সন্দেহের মধ্যে রেখো না, কারো সামনে ভুলেও প্রকাশ করোনা সে রাতে কি ঘটেছিল।’


আলীর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কমাণ্ডার অবহিত ছিল। সে নিশ্চিত হয়ে গেল। সন্দেহের অবসান ঘটল সেপাইদেরও।


দুপুরের খানা খাচ্ছিলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী, তাকে নাজির আগমনের সংবাদ দেয়া হর। খাওয়া শেষে তিনি তাকে ডেকে পাঠালেন। নাজির চেহারায় শংকা এবং ক্রোধের অভিব্যক্তি। কম্পিত কণ্ঠে সে বলল, ‘মহামান্য আমীর! পঞ্চাশ হাজার সুদানী ফৌজকে সদ্য প্রস্তুতকৃত ফৌজের সাথে একীভূত করার নির্দেশ কি আপনি দিয়েছেন?’


‘হ্যাঁ, অনেক চিন্তা ভাবনার পর এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আরো সিদ্ধান্ত নিয়েছি, মিসরের সেনাবাহিনীতে শতকরা ১০ জন থাকবে সুদানী সৈন্য। আপনাকে হেডকোয়ার্টারে বদলী করা হয়েছে, এখন থেকে আপনি আর সুদানী বাহিনীর প্রধান নন।’


‘মহামান্য আমীর, এ আমার কোন অপরাধের শাস্তি?’


‘সেনাবাহিনীর সামগ্রিক স্বার্থেই এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। সৈনিক জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কারণে হেডকোয়ার্টার আপনার সেবা নিতে চাচ্ছে, এ-তো আপনার জন্য খুশির খবর। কেবল একটা বাহিনী নয়, আপনি কি চাননা আপনার অভিজ্ঞতা থেকে উপকৃত হোক আমাদের সকল সৈনিক?’


‘আমীর, আমার আশংকা হচ্ছে, সম্ভবতঃ আমার বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র চলছে। আপনার মহান ব্যক্তিত্ব এবং বুদ্ধিমত্তা দিয়ে একটু যাচাই বাছাই করবেন। আমার মনে হয় কেন্দ্রে আমার কোন শত্রু রয়েছে।’


‘দেখুন, সেনাবাহিনী এবং প্রশাসনের ভুল বুঝাবুঝি দূর করার জন্যই এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। অফিসার হোক কি সাধারণ সিপাই, এখন থেকে সকলের জন্য মদ নিষিদ্ধ। কোন অনুষ্ঠানে নাচগান চলবে না।’


‘কিন্তু মাননীয় আমীর! আমিতো হুজুরের অনুমতি নিয়েই সবকিছু করেছিলাম।’


‘আপনি যাদেরকে মুসলিম মিল্লাতের সেনাবাহিনী বলছেন, তাদের আসল চরিত্র দেখার জন্য নাচ গানের অনুমতি আমি দিয়েছিলাম। পঞ্চাশ হাজার সৈনিককে তো চাকুরীচ্যুত করতে পারছি না, এ জন্য মিসরের ফৌজের সাথে একীভূত করে ওদের সংশোধন করতে চাচ্ছি। মনে রাখবেন, আমরা কেউ সুদানী, মিসরী বা সিরীয় নই। আমরা সবাই মুসলমান। আমাদের ধর্ম এক, পতাকাও এক।’


‘আমার অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা কি একবারও ভেবেছেন?’


‘দেখুন, এ সিদ্ধান্ত আপনার মনপুত না হলে আপনি সেনাবাহিনী থেকে ইস্তফা দিতে পারেন। আপনার ওপর আমি কোন কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না।’


‘মহামান্য আমীর, এ অন্যায়, এ জুলুম!’


‘কোনটা অন্যায় আর জুলুম তা বুঝার সাধ্যি কি আপনার আছে? নিজের অতীত একটু নিজেই তলিয়ে দেখুন গিয়ে, আমার মুখে শোনার প্রয়োজন হবে না।’


‘মহামান্য আমীর, এ সিদ্ধান্ত আরেকবার একটু বিবেচনার জন্য অনুরোধ করছি।’


‘অনেক ভেবেচিন্তেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ফিরে গিয়ে সব কিছু প্রস্তুত করুন। কোনরকম হটকারিতার আশ্রয় নেবেন না। মনে রাখবেন, আমার সহকারীর কাছে সাত দিনের মধ্যে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে হবে।’


নাজি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার মুখ খোলার আগেই কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী।


জুকি গভর্ণরের তাবুতে রাত কাটিয়েছে, নাজির গোপন হারেমেও এ সংবাদ পৌঁছে গিয়েছিল। ও এসেছে এই সেদিন, অথচ নাজি প্রথম দিন থেকেই অন্য সবার চাইতে ওকে বেশী ভালবাসে। এক মুহূর্তের জন্যও অন্য নর্তকীদের কক্ষে তাকে যেতে দেয়া হয়নি। জুকির জন্য ছিল আলাদা কক্ষ। নর্তকীরা প্রতিহিংসার আগুণে পুড়তে লাগল। সালাহউদ্দীন আইয়ুবীকে ফাঁসানোর জন্য জুকিকে ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে ওরা তা জানত না। ওদের ধারণা, জুকি নাজিকে এককভাবে দখল করে নিয়েছে। নর্তকী দু’জনের প্রতিহিংসা চরমে পৌঁছলে ওরা জুকিকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়।


গভর্ণরের তাবুতে জুকির রাত কাটানোর সংবাদে ওরা আরো পাগল হয়ে উঠল। কিভাবে তাকে হত্যা করা যায় ভাবতে গিয়ে ওদের মাথায় দুটি চিন্তা আসে। এক, তাকে বিষ প্রয়োগ করা যায়। দ্বিতীয়তঃ ভারাটে খুনী দিয়েও খুন করানো যায়। কিন্তু বাস্তবে দুটোর একটাও তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ জুকির খাওয়া দাওয়ার সবকিছু ছিল ওদের থেকে আলাদা, অন্যদিকে প্রহরী ছাড়া সে তার রুম থেকে বেরই হতো না।


ওরা হারেমের এক চতুর বাদীকে হাত করল। জুকিকে শেষ করতে পারলে প্রচুর ধন সম্পদ দেয়ার লোভ দেখাল তাকে। চাকরাণীটা ছিল লোভী এবং জঘন্য প্রকৃতির। হেরেমের অসংখ্য অপকর্মের হোতা ছিল সে।


প্রস্তাব শুনে সে বলল, ‘মুনীবের কক্ষে গিয়ে ওকে বিষ খাওয়ানো সম্ভব নয়। সুযোগমত খঞ্জর ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে এ জন্য কিছু সময়ের প্রয়োজন।’


‘কতদিন সময় প্রয়োজন তোমার?’


‘জুকির তৎপরতার ওপর নজর রাখতে হবে। হয়ত শীঘ্রই সুযোগ এসে যাবে।’


‘কিন্তু তারাতারি যদি সুযোগ না আসে?’


‘তাহলে ঘাতক দলের সহযোগীতা নিতে হবে। তবে ওরা এজন্য অনেক টাকা দাবি করবে।’


‘যত টাকা লাগে দেব, তবু আমারা চাই কাজটা তুমি তাড়াতাড়ি শেষ কর।’ বলল নর্তকীরা।


ক্রোধে উন্মুক্ত প্রায় নাজি কামরায় পায়চারী করছিল। জুকি তাকে শান্ত করার অনেক চেষ্টা করেছে। নাজির রাগ কমেনি।


‘আমাকে তার কাছে যেতে দিন।’ এ নিয়ে চতুর্থবারের মত বলল জুকি, ‘আমি তাকে সোজা পথে নিয়ে আসবো।’


‘কোন লাভ নেই।’ বেটা কমবখত হুকুম দিয়ে ফেলেছে, বাস্তাবয়নও শুরু হয়ে গেছে। আমার আর কিছুই রইল না। তোমার যাদু ওকে ধরেনি। আমার বিরুদ্ধে কারা ষড়যন্ত্র করছে জানি। ওরা আমার উন্নতি সইতে পারছে না। আমিই হতাম গভর্ণর। একজন সাধারণ সেনাপতি হয়েই সব শাসকদের শাসন করেছি আমি। আর এখন আমি একজন সামান্য কমাণ্ডারও নই।


নাজি প্রহরীকে ডেকে বললো, ‘জলদি এডরোসকে আসতে বলো।’


এডরোস এলে দু’জনে নতুন নির্দেশ নামার ব্যাপারে আলাপ করল। এডরোসের কাছে এ খবর নতুন না হলেও সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে কি পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে এ ব্যাপারে এডরোস কোন পরামর্শ দিতে পারলো না।


নাজি বলল, ‘কি করবো আমি ভেবে রেখেছি।’


‘কি ভেবেছেন?’


‘বিদ্রোহ করব।’


হতভম্বের মত তাকিয়ে রইল এডরোস


‘কি ব্যাপার, হতবাক হয়ে গেছ মনে হচ্ছে? বলতো পঞ্চাশ হাজার সুদানী ফৌজ আমাদের পক্ষে থাকবে, না সালাহউদ্দীনের পক্ষে? আমি ওদের বিদ্রোহের জন্য উস্কানি দিয়ে বলব, মিসর তোমাদের কিন্তু তোমরা এখন হবে ওদের দাস দাসী।’


দীর্ঘশ্বাস টেনে এডরোস বলল, ‘এ নিয়ে এখনো ভাবিনি। চোখের পলকেই তো বিদ্রোহ ঘটানো যায়। কিন্তু মিসের নতুন ফৌজ আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত এবং যথেষ্ট শক্তিশালী। ইচ্ছে করলেই ওরা বিদ্রোহ দমন করতে পারবে। সরকারের সাথে সংঘর্ষে যাবার আগে সবদিক ভেবে দেখা উচিৎ।


‘ভাবাভাবির কাজ শেষ। আমি খৃস্টান সম্রাটদেরকে সাহায্যের জন্য ডাকবো। দূত তৈরী কর, অনেক দূর যেতে হবে ওদের। এবার মন দিয়ে আমার পরিকল্পনার কথা শোন। জুকি তুমি নিজের ঘরে যাও।


জুকি ফিরে গেল নিজের কক্ষে। সারারাত দু’জন দরজা বন্ধ করে বিদ্রোহের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করল।


দুই ফৌজ একীভূত করার জন্য আইয়ুবী সাতদিন সময় দিয়েছিলেন। কাগজপত্র তৈরী হতে লাগল। পূর্ণ সহযোগীতা করছিল নাজি। চারদিন পার হয়ে গেছে, এর মধ্যে গভর্ণরের সাথে আরো একবার দেখা করেছিল নাজি, কিন্তু কোন অনুযোগ করেনি। কাজের বিস্তারিত রিপোর্ট দিয়ে আইয়ুবীকে আশ্বস্ত করেছিল। গভর্ণরের সহকারীও তাকে আশাব্যঞ্জক সংবাদ দিচ্ছিল, কিন্তু আলী বিন সুফিয়ানের দেয়া তথ্য ছিল উদ্বেগজনক।


গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে বলা হল, ‘সুদানী সৈন্যদের মাঝে অসন্তোষ বিরাজ করছে। গুজব ছড়ানো হচ্ছে মিসরের সেনাবাহীনীর সাথে একত্রিত করে সুদানী সৈন্যদেরকে তাদের দাস দাসীতে রূপান্তরিত করা হবে। যুদ্ধলব্ধ সম্পদে সুদানীদের কোন অংশ থাকবে না। বিশেষ করে কাউকে মদ পানের অনুমতি দেয়া হবে না।’


রিপোর্ট শুনে সালাহউদ্দীন আইয়ুবী বললেন, ‘অনেক দিনের বদ অভ্যাস, আমার এসন নীতি ওদের পছন্দ না হওয়ারই কথা। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, নতুন পরিবেশে এলে কিছুদিনের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ওই মেয়েটার সাথে আর দেখা হয়েছে আলী?’


‘না, দেখা করা সম্ভব হচ্ছে না। আমার পাঠানো লোকটাকে নাজি আটকে রেখেছে।


দিন পেরিয়ে কালো নেকাব পরে প্রকৃতিতে নেমে এসেছে রাত। এডরোসের সাথে রুদ্ধদ্বার কক্ষে বসেছিল নাজি। জুকি তার নিজস্ব কামরায়। ঘোড়ার পায়ের শব্দ কানে এল ওর। পর্দা তুলে বাইরে তাকাল জুকি।


দু’জন ঘোড়সওয়ার। পোশাক আশাকে ব্যবসায়ী মনে হচ্ছে।


ঘোড়া থেকে নেমে নাজির কক্ষের দিকে হাঁটা দিল ওরা। ওদের চলাচল জুকির কাছে ব্যবসায়ীর মত মনে হল না। ততোক্ষণে এডরোস বেরিয়ে এসেছে। থমকে দাঁড়াল আরোহী দু’জন। সামরিক কায়দায় স্যালুট করল। এডরোস ওদের পোশাক দেখে বলল, ‘প্রমাণ দাও।’


ওরা পোশাকের নীচে লুকানো অস্ত্র বের করল। ছোট তলোয়ার ওবং খঞ্জর।


ওদের ভেতরে নিয়ে গেল এডরোস। প্রহরী দাঁড়িয়ে রইল একপাশে।


গভীর চিন্তায় ডুবে গেল জুকি। কক্ষ থেকে বেরিয়ে নাজির কক্ষের দিকে হাঁটা দিল ও। পথরোধ করে দাঁড়িয়ে প্রহরী। বলল, ‘কারো ভেতরে যাবার অনুমতি নেই।’


সে বুঝে নিল কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে। দু’তিন রাত আগের কথা মনে পড়ল তার। নাজি এডরোসকে বলেছিল, ‘আমি খৃস্টান শাসকদেরকে সাহায্যের জন্য ডাকবো। তুমি দু’জন দূত তৈরী কর। ওদেরকে অনেক দূর যেতে হবে।’ এর পর জুকিকে বিদেয় করে বিদ্রোহের ব্যাপরের আলাপ করেছিল ওরা।


নিঃশব্দে নিজের কক্ষে ফিরে এল ও। নাজির খাস কামরার সাথে সংযুক্ত জুকির কক্ষের কপাট আঁটা। ও চুপিসারে দরজায় কান লাগিয়ে দাঁড়াল। ওপাশের কক্ষে অস্ফুট শব্দ। কিছুই বুঝা যাচ্ছিল না।


একটু পর ভেসে এল নাজির কণ্ঠ, ‘পরিষ্কার জনবসতি থেকে দূরে থাকবে। ধরা পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে এ চিঠি নষ্ট করে ফেলবে। পথে কেউ বাঁধা সৃষ্টি করলে হত্যা করবে নির্দয়ভাবে। চার দিনে সফর তিন দিনে অতিক্রম করতে হবে। মনে রেখো, তোমাদের রোখ থাকবে উত্তর পূর্ব দিকে।’


নাজির কক্ষ থেকে সেই দুই ব্যক্তি বেরিয়ে এল। বেরিয়ে এল জুকিও। এদের বিদায় দিতে নাজি এবং এডরোস আগেই বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিল। লোক দু’টো ঘোড়ায় চড়ে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেল। জুকির দিকে চোখ পড়তেই নাজি বলল, ‘আমি বাইরে যাচ্ছি, তুমি গিয়ে বিশ্রাম করো। একা একা ভাল না লাগলে হারেমে ঘুরাফিরা করতে পার।’


‘ঠিক আছে।’ জুকি বলল।


ও এখানে আসার পর থেকে একবারের জন্যও বেরোতে পারেনি।


নাজি এবং এডরোস চলে যেতেই ও নিজের কক্ষে ফিরে গাউন পরল। কোমরে একটা খঞ্জর গুঁজে হাঁটা দিল হারেমের দিকে। হারেমের মেয়েরা অবাক বিস্ময়ে ওর দিকে তাকাতে লাগল। এখানে ওর এই প্রথম আসা। সবাই আন্তরিকতার সাথে স্বাগতঃ জানাল ওকে। সেই দুই নর্তকী অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল ওর দিকে। কথা বলল হেসে হেসে। ‘


একটু পর বেরিয়ে এল জুকি। হারেম আর নাজির বসত বাড়ির মাঝখানটা নির্জন এবং এবড়ো থেবড়ো। নাজির বাড়ীল দিকে না গিয়ে ও অন্যদিকে চলে গেল।


এদিকে ছিল একটা পায়ে চলার পথ। সে পথ ধরে হাঁটতে লাগর জুকি। ওর পনর বিশ কদম পেছনে এক ছায়ামূর্তি। ছায়ামূর্তি তার চেহারা আপাদমস্তক কালো কাপড়ে ঢেকে নিঃশব্দে এগিয়ে আসছিল তার পিছু পিছু।


কিন্তু সতর্ক জুকি টের পেয়ে গের। সে তার চলার গতি বাড়িয়ে দিল, বেড়ে গেল ছায়ামূর্তির গতিও। সামনে ঘন ঝোপঝাড়। জুকি ঝোপের আড়ালে ঢুকে গেল, পেছনে ঢুকল ছায়ামূর্তি।


সেখান থেকে শ’তিনেক গজ দূরে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর বাসগৃহ। আশপাশে সেনা অফিসারদের বাস ভবন।


জুকি ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আইয়ুবীর বাড়ীর দিকে হাঁটতে লাগল। বায়ে উদয় হল ছায়ামূর্তী। ঝকঝকে জোৎস্নায়ও তার মুখ দেখা যাচ্ছিল না। বিড়ালের মত নিঃশব্দে এগোচ্ছিল সে।


ছায়ামূর্তির হাত উপরে উঠল, বিদ্যুৎ গতিতে একটা খঞ্জর নেমে এল জুকির বাম কাঁধ এবং ঘাড়ের মধ্যখানে।


আঘাত খেয়ে জুকিও কোমর থেকে খঞ্জর বের করল। ছায়ামূর্তি আরেকটা আঘাত করল ওকে। পাশ কটে নিজেকে বাঁচিয়ে ডান হাতের খঞ্জর ছায়ামূর্তীর বুকে আমূল বসিয়ে দিল জুকি।


ভেসে এল এক মরণ চিৎকার। চিৎকারটা নারী কণ্ঠের। জুকি এবার আঘাত করল ছায়ামূর্তীর পেটে। মাটিতে পড়ে গেল সে। আক্রমণকারীর দিকে না তাকিয়েই দৌড়াতে লাগল জুকি। রক্ত ঝরে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে ও।


সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর বাড়ীর অর্ধেক পথ এখনো বাকী, মাথা ঘুরতে লাগল ওর। গতি শ্লথ হয়ে এল। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে শরীর। সে এখন টলছে, পা পড়ছে এলোমেলো। ভয় হল, সে আর আইয়ুবীর বাড়ি পৌঁছতে পারবে না।


এবার ও চিৎকার করতে লাগল। ‘আলী, আলী, আইয়ুবী।’


রক্তে ভিজে গেছে ওর পোশাক। পা টেনে টেনে এগিয়ে চলছে ও। অনেক কাছে চলে এলেও মনে হচ্ছে আইয়ুবীর বাড়ী পর্যন্ত ও আসলেই পৌঁছতে পারবে না।


ও আলী এবং সালাহউদ্দীন আইয়ুবীকে ডেকেই যাচ্ছিল। ওর ডাকা ডাকির শব্দ কানে যেতেই ছুটে এল এক পাহারাদার। টলতে টলতে জুকি তার গায়ের উপরই হুমড়ি খেয়ে পড়ল।


পাহারাদারকে বলল, ‘আমাকে এক্ষুণি গভর্ণরের কাছে পৌছে দাও। জলদি। তাড়াতাড়ি কর।’


শোবার ঘরে বসে আলীর নিক থেকে রিপোর্ট নিচ্ছিলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। পাশে দু’জন পদস্থ কর্মকর্তা। আলীর রিপোর্ট অনুযায়ী সুদানী বাহিনীতে বিদ্রোহের সম্ভাবনা রয়েছে। এর বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা চলছিল।


আতংকিত প্রহরী ভেতরে প্রবেশ করল। কক্ষের চোখগুলো এক সংগে ঘুরে গেল তার দিকে। প্রহরী বলল, ‘পাহারাদার একজন আহত মেয়ে নিয়ে বাঁইরে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা গভর্ণরের সাথেদেখা করতে চাইছে।


তীরের মত কামরা থেকে বেরিয়ে গেল আলী। পেছনে সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। জুকিকে ভেতরে নিয়ে আসা হল। একজনকে পাঠিয়ে দেয়া হল ডাক্তারের জন্য। আইয়ুবী নিজের পালংকে শুইয়ে দিলেন ওকে। রক্তে ভিজে গেল বিছানার চাদর। ‘কাউকে ডাকতে হবে না।’ ক্ষীণ কণ্ঠে বলল জুকি, ‘আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি।’


‘জুকি, তোমাকে কে আহত করেছে?’ আলী প্রশ্ন করলেন।


‘আগে জরুরী কথা শুনুন। এখনি উত্তর-পূর্ব দিকে লোক পাঠিয়ে দিন। দেখতে পাবেন দু’জন অশ্বারোহী দ্রুত ছুটে যাচ্ছে। দু’জনের পরনেই বাদামী পোশাক। দেখতে ব্যবসায়ী মনে হবে। একজনের ঘোড়া ধুসর অন্যেররটা কালো। খৃস্টান সম্রাট ফ্রাঙ্কের কাছে নাজির লেখা চিঠি আছে ওদের কাছে। নাজি সুদানী বাহিনী নিয়ে বিদ্রোহ করবে। আমি আর কিছুই জানি না। আপনাদের দেশ ভয়ংকর সকটের মুখে। অশ্বারোহী দু’জনকে পথেই ধরে ফেলতে হবে। ওরা সব কিছু জানে।’ বলতে বলতে থেমে গেল জুকি। জ্ঞান হারিয়েছে ও।


দু’জন ডাক্তার দ্রুত ঘরে ঢুকলেন। রক্তক্ষরণ বন্ধ করার চেষ্টা করতে লাগলেন ওরা। ওষুধ খাওয়ানোর কয়েক মিনিট পর জ্ঞান ফিরে এল ওর।


জ্ঞান ফিরতেই জুকি নাজির সথে এডরোসের কথাবার্তা থেকে শুরু করে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করল। এরপর বলল, ‘আততায়ীকে আমি চিনিনা, আঘাত পেয়ে পাল্টা আঘাত করেছিলাম। তার চিৎকার শুনে মনে হয়েছে মহিলা। তবে এন পর্যন্ত বেঁচে নেই হয়ত।


সাথে সাথে আক্রমণ স্থলে লোক পাঠিয়ে দেওয়া হল। জুকির রক্তক্ষরণ বন্ধ হল না। ও সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর হাতে চুমো খেয়ে বলল, ‘আল্লাহ আপনকে এবং আপনার দেশকে অবশ্যই নিরাপদে রাখবেন। আপনি পরাজিত হতে পারেন না। সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর ঈমান কত দৃঢ় আমারচে বেশী কেউ জানে না।’


এরপর আলী বিন সুফিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি তো দায়িত্ব পালনে অবহেলা করিনি। যে জিম্মা আমাকে দিয়েছিলেন আমি তা পূর্ণভাবে পালন করেছি।’


‘তুমি অনেক বেশী পালন করেছ জুকি।’ আলী বললেন, ‘নাজি এতটা বিপজ্জনক আমি কল্পনাও করিনি, যার জন্য তোমায় জীবন দিতে হল। আমি শুধু তথ্য সংগ্রহের জন্য তোমাকে ওখানে পাঠিয়েছিলাম।’


‘হায়! আমি যদি মুসলমান হতাম।’ বেদনা ঝরে পড়ল জুকির কণ্ঠ থেকে। সাথে সাথে বেরিয়ে এল অশ্রু বন্যা।


‘আমাকে যে বিনিময় দেয়ার কথা ছির তা আমার অন্ধ পিতা আর চির রোগা মাকে পাঠিয়ে দেবেন। তাদের অপারগতাই বার বছর বয়সে আমাকে নর্তকী হতে বাধ্য করেছিল।


বাক রুদ্ধ হয়ে এল জুকির। হঠাৎ মাথা একদিকে ঢলে পড়ল। অর্ধনিমলিত চোখ আর ঈষৎ ফাঁক করা ঠোঁট দেখে মনে হচ্ছিল ও মৃদু হাসছে। ডাক্তার ওর নাড়িতে হাত রাখলেন। করুণ চোখে চাইলেন আইয়ুবীর দিকে।


‘ও যেই ধর্মেরই হোক, সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হবে ওকে।’ বললেন আইয়ুবী। ‘ইচ্ছে করলে আমাদের ধোঁকাও দিতে পারতো। কিন্তু তার পরিবর্তে ও ইসলামের জন্য জীবন বিলিয়ে দিয়েছে।’


প্রহরী এসে বলল, ‘একজন মহিলার লাশ নিয়ে আসা হয়েছে।’ সবাই দেখলো মধ্যবয়সী এক অপরিচিতা মহিলা। আক্রান্ত স্থানে দু’টো খঞ্জর পাওয়া গেল। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল, মহিলা ছিল নাজির হারেমের চাকরাণী, যার জন্য কেউ তাকে চিনতে পারেনি।


অত্যন্ত গোপনে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় জুকিকে সমাহিত করা হল। মাটি খুড়ে পুঁতে রাখা হল মহিলার লাশ।


রাতেই সালাহউদ্দীন আইয়ুবী পত্রবাহী অশ্বরোহীদের ধরে আনার জন্য আটজন দুঃসাহসী ঘোড়সওয়ার প্রেরণ করলেন। জুকির নির্দেশিত পথ ধরে ধাওয়া করে ছুটল ওরা। মরুভূমির ধুলো উড়িয়ে দ্রুত এগিয়ে চলল আলী বিন সুফিয়ানের নেতৃত্বে।


জুকি ছিল মরোক্কোর এক নর্তকী। তার ধর্ম সম্পর্কে কেউ জানতে পারেনি। নাজি শত্রুর বিরুদ্ধে সুন্দরী যুবতী এবং হাসিস ব্যবহার করে একথা জানত আলী। তাই সে এক বিশ্বস্ত লোকের মাধ্যমে মরক্কো থেকে জুকিকে আনিয়েছিল। এরপর নারী ব্যবসায়ী ছদ্মবেশে নিজেই ওকে নাজির কাছে বিক্রি করেছিল। মেয়েটার মধ্যে ছিল যাদুর চমক। নাজি ওকে সালাহউদ্দীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে গিয়ে নিজেই ফেঁসে গেল। নাজির গোপন বৈঠকে হাজির থাকত জুকি। সম্বর্ধনার রাতে ওকে আইয়ুবীর তাবুতে পাঠিয়ে নাজি ভীষণ খুশী হয়েছিল। এতদিনে পাথর গলানো যাবে, মেয়েটা তাকে মদ খাওয়াবে, এরপর তাকে নিজের ইচ্ছেমত গড়ে নিতে কতক্ষণ- এই ছিল নাজির ভাবনা। কিন্তু নাজি জানত না জুকি আইয়ুবীর চর। সে রাতে ও সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর তাঁবুতে তার ওপর অর্পিত কাজের রিপোর্ট দিয়েছিল। তাবু থেকে বেরিয়ে দেখা করেছিল আলীর সাথে। আলী ওকে পরবর্তি নির্দেশ দিয়েছিল। এরপর নাজির বাড়ী থেকে আর বের হওয়ার সুযোগ পায়নি ও। সুযোগ যখন পেল, ঘাতকের খঞ্জর কেড়ে নিল ওর প্রাণ।


জুকির মৃত্যুর পর প্রতিশ্রুত পারিশ্রমিক, নাজির কাছ থেকে নেয়া বিক্রয়লব্ধ অর্থ এবং আইয়ুবীর দেয়া উপহার সামগ্রী মরক্কোয় পাঠিয়ে দেওয়া হল বাপ-মার কাছে।


মৃত্যুর আতংক জড়ানো বিষন্ন রাতের আঁধার কেটে গেছে। গা জ্বলা তীব্রতা নিয়ে উঁকি দিয়েছে মরু সূর্য। আলী বিন সুফিয়ান তখন জনবসতি থেকে অনেক দূরে। সাথে আটজন সশস্ত্র অশ্বারোহী। যাচ্ছিল উত্তরপূর্ব দিকে। সম্রাট ফ্রাঙ্কোর রাজধানীর পথ আলীর চেনা। ক্লান্ত হলেও আরবী ঘোড়াগুলো এখনো সপ্রতিভ। দূরদিগন্তে দৃষ্টি ছুঁড়লেন আলী। খর্জ্জুরবীথির পাশ ঘেঁষে এগিয়ে যাচ্ছে দু’জন অশ্বারোহী।


পথ পরিবর্তন করে পাহাড়ের আড়াল নিয়ে এগুতে লাগলেন তিনি। আলী ছিলেন মরুভেদী। পথ হারানোর সম্ভাবনা ছিল না। সওয়ার দু’জন এখনো মাইল চারেক দূরে, গতি বাড়িয়ে দিলেন আলী।


অবসন্ন হয়ে পড়েছে ঘোড়া। খর্জুর বীথির কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে সওয়ার দু’জন আরো মাইল দুয়েক এগিয়ে গেছে। চলছে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। ওদের ঘোড়াও সম্ভবতঃ ক্লান্ত। ঘোড়া থেকে নেমে পাহাড়ের আড়ালে চলে গেল লোক দুটো। আলী আবার পথ পরিবর্তন করলেন। দু’দলের মধ্যে দূরত্ব কমে এল। এখন মাত্র কয়েকশ গজের ব্যবধান।


লোক দুটো অশ্ব ক্ষুরের শব্দে বেরিয়ে এর। আলীদের দেখে দ্রুত ঘোড়ায় চড়ে পালাতে লাগল ওরা। সামনে বালিয়াড়ি। ভয় পেয়ে ওরা একবার ডানে একবার বায়ে যাচ্ছিল। একজন তীরন্দাজ চলতি ঘোড়া থেকে তীর ছুঁড়ল। একজনের ঘোড়ার পায়ে বিঁধতেই লাফিয়ে উঠল ঘোড়াটা। টাল সামলাতে না পেরে ছিটকে পড়ল আরোহী। আলী ওদের ঘিরে ফেললেন। দু’জনকেই বেঁধে ফেলা হল।


আলীর প্রশ্নের জবাবে ওরা নিজেদের ব্যবসায়ী পরিচয় দিল। তল্লাশীর পর পাওয়া গেল নাজির লেখা চিঠি। আলী খানিক বিশ্রাম করে বন্দীদের নিয়ে রাজধানীর পথ ধরলেন।


চরম উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুণছিলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। দিন শেষে রাত এল। গভীর হয়ে এল রাতও। অনেক রাতে বিছানায় পিঠ লাগালেন আইয়ুবী। ভোর রাতে দরজায় মৃদু করাঘাতের শব্দে জেগে উঠলেন তিনি। তড়িঘড়ি দরজা খুলে দেখলেন বাইরে দাঁড়িয়ে আছে আলী। পেছনে আটজন সওয়ার এবং দু’জন বন্দী। আইয়ুবী সকলকে ভেতরে ডেকে নিলেন। নাজির চিঠি এগিয়ে দিল আলী।


চিঠি খুললেন আইয়ুবী। কয়েক লাইন পড়তেই ক্রোধে বিবর্ণ হয়ে গেল তার চেহারা। পলকে আনন্দ ঝলকে উঠল চোখে মুখে। নাজি তার দীর্ঘ চিঠিতে খ্রিষ্টান সম্রাট ফ্রাংককে আক্রমণের জন্য দিনক্ষণ ঠিক করে দিয়েছে। লিখেছে, রোম উপসাগর উপকূলে নৌবহর থেকে খৃস্টান সৈন্যরা নেমেই মিসর আক্রমণ করবে। এদিকে বিদ্রোহ করবে পঞ্চাশ হাজার সুদানী ফৌজ। সালাহউদ্দীনের নতুন সৈন্যরা এক সঙ্গে দুই ফৌজ মোকাবিলা করতে পারবে না। এর বিনিময়ে নাজি সমগ্র মিসর অথবা মিসরের একাংশ ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব করেছে।


‘জেলে পাঠিয়ে দেয়া হল বন্দী দু’জনকে। নাজি এবং তার সঙ্গীদের নিজস্ব বাসগৃহে নজরবন্দী করা হল। নাজির হারেমের মেয়েদেরকে ছেড়ে দেয়া হল। বাজেয়াপ্ত করা হল নাজির ব্যক্তিগত সম্পত্তি। এ সব কিছুই করা হল অত্যন্ত গোপনে ও সতর্কতার সাথে। নাজি লিখিত চিঠি দু’জন দূত মারফত শুধু আক্রমণের তারিখ পরিবর্তন করে ফ্রাঙ্কোর কাছে পাঠিয়ে দিলেন আইয়ুবী। দুই সেনাবাহিনীর একত্রীকরণ সাময়িকভাবে স্থগিত করে দেয়া হল।


দূত ফিরে এল আট দিন পর। নাজিকে জবাব লিখেছেন ফ্রাঙ্ক। সালাহউদ্দীন যেন আক্রমণ প্রতিহত করতে না পরে এজন্য আক্রমণের দুদিন আগেই বিদ্রোহ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এ সংবাদ গোপন রাখার স্বার্থে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর অনুমতি নিয়ে আলী দু’জন দূতকে সসম্মানে গৃহবন্দী করে রাখলেন।


* download full app from the link given below : https://play.google.com/store/apps/details?id=com.arefin.crushedseries

1 view0 comments
bottom of page